তেঁতুল গাছ (Tamarind tree)-প্রাচীন কাল খেকেই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলসহ শহরের বাসা/বাড়ীর পতিত জমি, ঝোপ, বাঁশ ঝাড়, আম কাঠালের বাগানসহ বিভিন্ন স্থানে দেখাযেত বড় বড় তেঁতুলের গাছ। কিন্ত বর্তমানে প্রায় ১যুগের মধ্যে তা আর চোখেই পড়েনা! কালের বিবর্তনে পরিবেশ ও মানব জাতির কল্যানকর মূল্যবান এ ভোজষ গাছটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
তেঁতুল গাছের বিবরন-(Description of tamarind tree)-বিভিন্ন উদ্ভিদ ভিত্তিক পুথি বা গ্রন্থ থেকে জানা যায়- জন্মগত ভাবেই তেঁতুল গাছ একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় গাছ। এটি আফ্রিকা অঞ্চলীয় জাম্বিয়া, ক্যামেরুন, তানজানিয়া, সুদানসহ আরও কয়েকটি বনাঞ্চলে এর ব্যাপক ভাবে দেখা যেত। তেঁতুলগাছ একটি সুদৃশ্য চির সবুজ বৃক্ষ। প্রচুর শাখা প্রশাখাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতায় ভরপুর থাকে এ গাছ। পাতার ঘনত্বের কারনে গাছের মুল কান্ডে বা দেহে চাঁদ ও সূর্যালো প্রবেশ করতে পারেনা। এমন কি এ গাছের ডাল বা কান্ডে বসে থাকলে মাটি থেকে দেখাই দুঃসাধ্য হয়ে যায়। ফলে দিনে দুপুরেই এ গাছটিতে উঠলেও অন্ধকারাছন্ন দেখা যায়। আর তাইতো এ গাছটিকে গ্রাম্য প্রবাদে ভূতরে গাছ বলা হয়ে থাকে। এটি একটি দীর্ঘজীবি গাছ, নানান প্রতিকুলতার আবহাওয়ায় এটি বেঁচে খাকতে পারে। এ গাছটির কান্ড ও গুল অত্যান্ত শক্ত হয়ে থাকে, এ গাছের শেকড় অনেক বিস্তৃত থাকে, ফলে এটি ঝড়-বাতাশে সহজে ভেঙ্গে ও উপড়ে পড়েনা।
তেঁতুলের জাত-(Tamarind variety)-তেঁতুলের জাত প্রাচীন কাল থেকেই আমরা এক প্রকারের খেয়ে বা দেখে আসছি। এটির অনুমোদিত একাধিক কোন জাত নেই। তেঁতুল ফল কাঁচা বা পাঁকা দুটোই স্বাদে অত্যান্ত টক। এটি কাঁচাপাাঁকা দুভাবেই খাওয়া যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে সরকারি ও বে-সরকারিভাবে মিষ্টি তেঁতুলের জাত নিয়ে গবেষনা ছলছে।
তেঁতুল ফুল ও ফলের মৌসুম-(Tamarind flower and fruit season)- জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে তেঁতুল গাছের ফুল আসে, ফুলের পাঁপড়ি থাকে পাঁচটি, ফুলের রং হালকা বাদামি হয়ে থাকে, মৌমাছি, মাছি জাতীয় পতঙ্গ দ্বারা এর পরাগয়ন ঘটে থাকে। এর ফল একেকটি ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। ফলটি বেশিরভাগ কাস্তের ন্যায় বাঁকা হয়ে থাকে, আবার কিছু কিছু ফল সোজাও হয়ে থাকে। এ ফলটি গাছের শাখা প্রশাখায় থোকা থোকায় ধরে। ফাল্গুন ও চৈত্রমাসে এর ফল পেকে যায়।
তেঁতুল ফল ও গাছের উপকারিতা-(Benefits of tamarind fruit and tree)-বিভিন্ন চিকিৎসা শাস্ত্র সূত্রে জানা যায়-তেঁতুল মানব জীবনের অসংখ্য ভোজষের কাজ করে থাকে। যেমন-(১) তেঁতুলে হজম শক্তি বৃদ্ধিসহ কোষ্ঠকাঠিন্য দুর করে। সেই সাথে তেঁতুলের পাতার রস ডায়রিয়ায় যথেষ্ট উপকারি। (২) তেঁতুল ফলের বিচি গুড়ো করে নিয়মিত খেলে ডায়াবেটিস রোগিদের ইন্স্যুলেনের উপকার করে। (৩) প্রতিদিন পিরিমিত পরিমানে তেঁতুল খেলে ইহা শরীরের যে কোন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। সেই সাথে কিডনি সুস্থ্য ও সবল রাখে। (৪) তেঁতুল পাতার রসে অতিরিক্ত মাদকাশক্তদের ডেম্যাজড্ লিভারের উপকার করে, সাথে যকৃতের ভীষন উপকার করে। (৫) তেঁতুল বীজের গুড়ো খেলে পেপটিক আলসার থেকে দ্রুত নিরাময় লাভ করা যায়। (৬) নিয়মিত পরিমিত তেঁতুল খেলে অতিরিক্ত মেদ ও ফ্যাট রোগিদের আশানুরুপ উপকার পাওয়া যায়। (৭) উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ও মাত্রাতিরিক্ত নেশার নেশা কাটতেও ফলপ্রসূ কাজ করে। (৮) তেঁতুল গাছের ছাল ও পাতার রস শরীরের যে কোন ক্ষত সারাতে অগ্রনি ভূমিকা পালন করে। কারন এতে রয়েছে অ্যান্টি সেপটিক ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়া রোধক গুন। (৯) নিয়মিত পরিমিত তেঁতুল খেলে শরীরের ভিটামিন সির ঘাটতি পূরনসহ সর্দিকাশি প্রতিরোধ করে। (১০) নিয়মিত পরিমিত তেঁতুল খেলে নারিী/পুরুষের ত্বক উজ্জল রাখে। (১১) তেঁতুল পাতার রস খেলে পাইলস, প্রসাব সহ হাত ও পায়ের জ্বালাপোড়ায় আশানুরুপ ফল পাওয়া যায়। (১২) হার্ডের রোগিদের জন্য তেঁতুল কুবই উপকারি। (১৩) কৃমিনাশকে তেঁতুল পাতার রস অত্যান্ত ফলদায়ক। (১৪) গর্ভবতী মহিলাদের বমি বমি ভাব দুরিকরনে ইহা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। (১৫) তেঁতুলে ক্যালসিয়াসমর অভাব দুর করে। (১৬) এটি বাত ও জয়েন্টের ব্যাথায় যথেষ্ঠ ফলদায়ক কাজ করে। (১৭) তেঁতুল পাতার রস খেলে জন্ডিস রোগ ভাল হয়। (১৮) তেঁতুল খেলে শরীরের কনিজ পদার্থের অভাব দুর করে। (১৯) তেঁতুল পাতার রস দিয়ে চা খেলে ম্যালেরিয়া জ্বর ভাল হয়। (২০) তেঁতুলে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায়। তেঁতুলের আঁচার নারী/পুরুষের নিকট একটি জনপ্রিয় খাবার, তবে ভরাপেটে খেলে সব থেকে বেশী উপকার পাওয়া যায়।
তেঁতুল ফলের অপকারিতা-(Disadvantages of tamarind fruit)-তেঁতুলে যেমন মানব জীবনে অসংখ্য রোগের উপকার করে তেমনি মাত্রাতিরিক্ত খেলে আবার শরীরের নানাবিদ সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-(১) তেঁতুল বা তেঁতুলের আঁচার মাত্রাতিরিক্ত সেবন করলে, এলার্জির , চুলকানি পাচড়া, বমি বমিভাবসহ স্বসকষ্ট রোগিদের পার্শপ্রতিক্রিয়া দেখাদিতে পারে। (২) দন্তরোগিদের ক্ষেত্রে (৩) পিত্তথলিতে পাথর সৃষ্টিতে সহযোগিতা (৪) শরীরে এসিড রিফ্লাক্স বৃদ্ধি (৫) রক্তের সিরাম গ্লুকোজ বৃদ্ধি (৬) রক্ত নালীকে সংকোচন করাসহ রক্ত প্রবাহের ধারার গতি কমাতে পারে। সেই সাথে (৭) যেনারা অ্যাসপিরিন, ইবুপ্রেফেন, ন্যাপ্রেক্সিন এর মত নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ড্রাগ গ্রহন করে থাকেন, তাদের জন্য মারাক্তক পার্শপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে তেঁতুল চাষের এলাকা-(Areas of tamarind cultivation in Bangladesh)-প্রাচীন কাল থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের বন জঙ্গঁল, রাস্তার ধার, বাসা/বাড়ীর পতিত জমিতে পাখির মাধ্যমে তেঁতুল বীজ পড়ে গাছ জন্মে থাকে। কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে এ গাছ রোপন করেনা। তবে ক্লোফট গ্রাফ কাটিয়ের মাধ্যমেও এর চারা তৈরি করা যায। গ্রাফটিং চারার মাধ্যমে অল্প সময়েই মানসম্মত ফলন পাওয়া সম্ভব। বংলাদেশের সব ধরনের মাটিতেই এর চাষ করা সম্ভম। তবে আশানুরুভাবে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও গাজীপুর জেলায় এ গাছটিকে জন্মিতে দেখা যায়।
তেঁতুল গাছ দ্রুত বিলুপ্তির কারন-(The reason for the rapid extinction of tamarind trees)-তেঁতুল গাছের খড়ি অন্যান্য জ্বালানি কাঠের চেয়ে অধিক পরিমানে জ্বলে এবং এর আগুনের দম অকনক বেশী থাকে। এ কারনে দেশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটা মালিকসহ বড় বড় কনফেকশনারির মালিকগন সাধারন জ্বালনি কাঠের চেয়ে তেঁতুল গাছের কাঠকেই অধিক অর্থদিয়ে ক্রয় করে থাকেন। অধিক অর্থের লোভে গ্রামাঞ্চলের তেঁতুল গাছের মালিকগন শতবর্ষী তেঁতুল গাছসহ মাঝাড়ি সাইজের তেঁতুলগাছ বিক্রি করে সাবাড় করে ফেলেছেন। ফলে দিন দিন প্রকৃতি ও মানব কল্যাণকর এ গাছটি বর্তমানে বিলুপ্ত হতে বসেছে ।
লেখক/Author
অমিতাব বর্মণ।
ভেন্ডাবাড়ী, পীরগঞ্জ-রংপুর।
১৪/০২/২০২২ইং।
Thank you for reading this article please shear this and srprot my websites to grow futher.