ভূমিকা-(Introduction)- প্রকৃতির অনন্য ঐতিহ্য দেশী বা জংলী খেজুরের গাছ কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে প্রকৃতির মানচিত্র থেকে। গ্রামীন জনপদের রাস্তাঘাটের অপরুপ শোভাবর্ধণ কারি এ গাছটি শুধু কি শোভা বর্ধণ করতো ? না এটি শীতকালে গ্রামীন অর্থনীতিতে যৎসামান্য অর্থনৈতিক ভূমিকাসহ চাহিদা মেটায় অতুলনীয় স্বাদের রস এবং মূল্যবান খেজুর গুড়ের। কয়েক বছর আগেই গ্রাম বাংলার মেঠো পথের দু ধারে অহরহ সারিবদ্ধ ভাবে শোভা পেত দৃষ্টিনন্দন এ গাছটি। বর্তমানে তা খুজে পাওয়া দায়, তবে কিছু এলাকায় গাছ প্রেমি মানুষের উদ্দেগে দু-একটি এলাকায় নতুন করে শোভা পেতে দেখা যাচ্ছে এ গাছটিকে।
খেজুর গাছের বিবরন-(Description of date/palm tree)-বাংলাদেশে সাধারনত খেজুর গাছ সাধারনত দু-ধরনের দেখতে পাওয়া যায়- (১) দেশী বা জংলী খেজুর (Desi or wild dates) , (২) আরবি বা সৌদি খেজুর (Arabic or Saudi dates)। উদ্ভিদ তথ্য গ্রন্থাগার থেকে জানা যায় খেজুর গাছ এ্যারিকেসি গনভুক্ত (The Phoenix genus of the Ericaceae family)। বিশ্বে মোট ১৪ প্রজাতীর এ ধরনের গাছ রয়েছে। এ সবের মধ্যে দেশী বা জংলী এবং সৌদি খেজুর এ দু ধরনের খেজুর গাছেই রস ও সুস্বাদু ফলের জন্য বিখ্যাত। এটি একটি এক জীব পত্রী বা একলিঙ্গ বিশিষ্ট বৃক্ষ। দেশী খেজুর বেশ দ্রুত বর্ধনশীল শাখাবিহীন এক কান্ড বিশিষ্ট গাছ। এটি নারিকেল, তাল, সুপারী গাছের ন্যায় জন্মে, গ্রীষ্মকালে এর ফল পাওয়া যায়।
জন্ম ও উৎপত্তি -(Birth and origin)-বংলাদেশের সবে এলাকাতেই জন্মে দেশী বা জংলী খেজুর গাছ। ইহা ছাড়া এটি বিশেষ করে হিমালয়ের পশ্চিোংশ থেকে পূর্ব এশিয়ার ভারতবর্ষ, নেপাল ও মিয়ানমারের আবহাওয়া বিশেষ উপযেগি। বাংলাদেশের বিখ্যাত সুন্দর বনসহ উপকূলীয় অঞ্চল গুলোতে দেখা যায় এর বংশবিস্তার। প্রধানত প্রাকৃতিক ভাবেই এ দেশী খেজুরগাছ জন্মে থাকে, মূলত কাঠবিড়ালী ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরাই এর বিস্তারক।
বাংলাদেশের গ্রামীন অর্থনীতি ও প্রকৃতিতে দেশী খেজুরের গুরুত্ব-(The importance of native dates in the rural economy and nature of Bangladesh)- বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের চাষ হলেও দেশী বা জংলী খেজুরের বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়না। তবে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও গ্রামীন অর্থনৈতিতে প্রাচীনকাল থেকেই দেশী খেজুরের গাছ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে আসছে। এ দেশের প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলের গাছী সম্প্রদায় অর্থাৎ (যারা খেজুর গাছ খেখক রস সংগ্রহ করে তাদেরকেই বলা হয় গাছী )। শীত মৌসুমে খেজুুরের রস সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সেই সংগ্রহকৃত রস প্রতিদিন প্রত্যুষে ভোর বেলা খেকে সকাল ১০টার মধ্যে গ্রামে গ্রামে অথবা গ্রামাঞ্চলের হা-বাজার গুলোতে কলস বা হাড়ি ভরে ভারে করে কেজী বা গ্লাস দরে বিক্রি করে থাকে। এ রস অত্যান্ত সুস্বাদু ও জনপ্রিয়। শীতের সকালে খেজুর রস পান না করলে অনেকের চলবেই না। টাটকা রস বিক্রির পর অবিক্রিত রসদিয়ে গাছীরােই তৈরী করেন খেজুর গুর। এই গাছী সম্প্রদায়ের লোকজনই গ্রামাঞ্চলের রাস্তার দুপার্শে সারিবদ্ধ ভাবে খেজুর গাছ লাগিয়ে থাকেন। পাশাপাশী কিছু গাছ প্রেমী মানুষও অনেক ক্ষেত্রে পতিত জমিসহ জমির আইলে এ গাছ লাগিয়ে থাকেন।
খেজুর গুড়ের বাহারী খাদ্য তালিকা-(External food list of date molasses)-খেজুর রসের গুড় দিয়ে এ দেশের বাঙ্গালীদের জন্য শত শত বছর ধরে বাহারী সুস্বাদু খাবারের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। আখের গুড় ১শত ২০ থেকে ৫গ টকা কেজী বিক্রি হলেও খেজুর গুড় বিক্রি হয় ২শত ৫০ থেকে ৩শত টাকা। খেজুর গুড়দিয়ে বিভিন্ন নামীদামী মিস্টির দোকানে তৈরী করা হয়-উচ্চ মূল্যের রসগোল্লা, জিলাপি, সন্দেস, খেজুর গুড়ছানা, খেজুর গুড়মিঠাই, পিঠা-পায়েস ইত্যাদি। শুধু কি তাই ? এ দেশে বসবাস রত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায় বা গোষ্টি খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করে থাকেন-উচ্চ মূল্যের চোলাই মদসহ বিয়ার ।
খেজুর গাছের গৃহস্থলি ব্যবহার-(Household use of date palms)-থেজুর গাছ দিয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রাচীন কাল থেকে ঘরের বর্গা, ঘরের ছাদের বিছানিসহ ছোট খাল বা নালা পারাপারের জন্য মানুষ ও মালামাল বহনকারি ঠেলাগাড়ী পারাপারের জন্য খেজুর গাছের গুল ব্যবহার করা হত। বর্তমানে এ গাছের গুল অত্যান্ত মজবুত হওয়ায় টিনের ঘরের মুল্যবান রুয়া, বাতা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এ গাছের গাছের কাঠের বৈশিষ্ট সহজে ঘুন পোকা আক্রমন করতে পারেনা। ইহাছাড়াও খেজুর গাছের পাতা দিয়ে গ্রামাঞ্চলে পাটি, মাদুর, ঝুড়ি, হাতব্যাগ, ফুলদানিসহ ইত্যাদি কারুপন্য তৈরি করা হয়।
খেজুর গাছ বিলুুপ্তের কারন-(The reason for the extinction of native date palms)-প্রাচীন কাল থেকে শহর খেকে শুরু করে প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলের রাস্তার দুধারে পুকুর পাড়ে, পতিত জমি, জমির আইলে, বাড়ীর উঠানসহ অহরহ শোভা পাইত এই প্রকৃতির শোভা বর্ধনকারি খেজুর গাছ। কিন্তু বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও রাস্তা ঘাটের উন্নয়নের যাতাকলে রাস্তা প্রসস্ত করন সহ ব্যাপক হারে বাসাবাড়ী নির্মানে জায়গার সংকুলানে এ সমস্ত গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু নতুন করে আর এ গাছ লগোনো হয়নি। পাশাপাশি ইট ভাটায় খড়ির চাহিদা মেটাতেও এর ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দিন দিন বিলুপ্ত হতে বসেছে এ খেজুর গাছ।
বাংলাদেশে খেরর রস ও খেজুর গুড় উৎপানের বিখ্যাত এলাকা সমুহ-(Famous areas for production of Kherr juice and date molasses in Bangladesh)- এ দেশের জলবায়ুর কারনে বাংলাদেশের বিষেশ করে ফরিদপুর, নাটোর, রাজশাহী ও যশোর জেলায় তুলনামুলক ভাবে বেশী দেখা যায় এ গাছটিকে। বাংলাদেশ কৃষি সমপ্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়- ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি ভাবে উদ্যোগ নিয়ে দেশী খেজুর গাছ সংরক্ষন ও সম্প্রসারনে উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে।
উপসংহার (Conclusion)(Conclusion)-দেশের সচেতন মহল ও পরিবেশ বাদিরা বিভিন্ন মতবাদে এ গাছটিকে সংরক্ষনে সরকারি ভাবে জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহন করে শুধুমাত্র দেশের গ্রামীন রাস্তা গুলোর দুধারে শারিবব্ধ ভাবে চারা রোপনের উদ্যাগ নিলে খেজুর গুড়ের দেশর চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে এ সুস্বাদু গুড় রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব।
লেখক/Author
সাংবাদিক অমিতাব বর্মণ।
ভেন্ডাবাড়ী, পীরগঞ্জ-রংপুর।
বাংলাদেশ।
No comments:
Post a Comment