Tuesday, November 23, 2021

পান চাষে (Drink cultivation) অর্থ ও পানের ঔষধি গুন!!

 

পানঃ-

পান গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার গুল্মজাতীয় গাছের পাতা। প্রচীন কাল থেকে মূখের দুর্গন্ধ নিবারন ও নিশ্বাসকে সুরভিত করতেই পান খাওয়ার সূচনা হয়। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবেই পানের ব্যবহার চলে আসছে দীর্ঘদিন থেক। অনুষ্ঠানাদিতে আহারের পর পান পরিবেশন করা না হলে কেমন জানি অপূর্নতাসহ অভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের পান খেয়ে থাকে। তন্মধ্যে ঢাকাই খিলিপান বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। খানদানি ও উচ্চ বংশীয় পরিবার গুলোতে বয়োবৃদ্ধ মহিলাগণ পানদানিতে পান রেখে তাদের বন্দুবান্ধব ও আত্মিয়স্বজনের সাথে অবকাশ যাপন করে থাকেন। হিন্দু ধর্মালম্বীদের উৎসব, পূজা অর্চনায় এখনো পান একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমন কোন পুজো নেই যে পান ছাড়া হয়।
পানচাষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ-(A brief history of betel cultivation)-১৮৭২ এবং ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে, সবচেয়ে বেশী পান উৎপাদন হত বর্ধমান, মেদিনিপুর, যশোর এবং ঢাকা, দিনাজপুর ও রংপুর জেলায়। বাংলাদেশে আদিকাল থেকেই হিন্দু ধর্মালম্বীরাই পান চাষের সূচনা করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বারুই  সম্প্রদায় এ পান চাষ করত। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বাংরাদেশে বর্তমানে পান উৎপাদনের সিংহভাগই হচ্ছে মুসলমান কৃষকদের হাতে। শুধু বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসী বা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির মধ্যে খাসি-রাই একমাত্র আদিবাসী যাদের প্রধান পেশা পান চাষ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অনেক বারুই জমিদারি ও তালুকদারির মালিক হয়। মুসলমান শাসনামলে কৃষকদের মাঝে বারুই শ্রেণি ছিল সবচেয়ে বেশি ধনী।

পানের ঔষধি গুনাগুণঃ-(Medicinal properties of the drink)-১. পান পাতা খাওয়ার ফলে যে রস উৎপাদন হয় তা আমাদের দাঁত আর মাড়ি সুস্থ রাখে। ২. পান পাতার রস আমাদের মুখের ভেতরটা পরিষ্কার রাখে, এমনকী মুখের মধ্যে রক্তপাতও বন্ধ করে, সান স্ট্রোক হওয়ার ফলে নাক দিয়ে রক্ত পড়লে পান পাতা পাকিয়ে তা নাকের মধ্যে গুঁজে দিয়ে, মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে রাখেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ৩. কানের ব্যথা কমাতে কয়েক ফোঁটা পানের রস আর কয়েক ফোঁটা নারকেল তেল একসঙ্গে মিশিয়ে কানের মধ্যে দিলে ব্যথা কমে যাবে। ৪. ছোটখাটো কাটা ছেড়ায় পান পাতা বেটে লাগিয়ে দিলে এটি এন্টিবায়োটিক এর কাজ করবে। ৫. গোসল করার পানিতে কিছুটা পান পাতার রস পািনতে মিশিয়ে গোসল করলে সারাদিন ফ্রেশ লাগবে। পান পাতা দিয়ে পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে সেই পানি পান করলে ঘামের গন্ধ কমাসহ পানে মহিলাদের মেনস্ট্রুয়েশন স্মেল ও কমানো সম্ভব। ৬. কিডনি রোগীরা দুধের সাথে পান পাতা বেটখেলে প্রস্রাবের কষ্ট থেকে আরোগ্য লাভ করবেন। পান পাতায় শরীর থেকে দ্রুত পানি বের করে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে ।  ৭. পান পাতার রস সেবনে মহিলাদের প্রসস্থ্য  যোনিপথ সংকুচিত করতে যথেষ্ট কাজ করে। ৮. কয়েক ফোটা পান পাতার রস আর কাঁচা হলুদ এক সঙ্গে বেটে নিয়ে কয়েকদিন স্কিন অ্যালার্জি‚ ফুসকুড়ি‚ কালো ছোপ‚ সান বার্নে লাগালে দ্রুত উপসম পাওয়া যাবে। ৯. মাথা ব্যথায় কয়েক ফোটা পান পাতার রস কপালে মালিশ করলে নিমিষেই আরোগ্য লাভ হবে।  ১০. মহিলা /পুরুষের গোপনাঙ্গের আশে-পাশে ও পায়ের আঙ্গুলের ইনফেকশনে কয়েকদিন পানপাতার রস লাগালে দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।  ১১.  মধুর সঙ্গে পান পাতা বেটে খালে শরীর ও মনের এনার্জি শক্তি বৃদ্ধি পায়।  ১২. সরিষার তেল আর পান পাতার রস গরম করে বুকে লাগালে শীতে শরীর গরম থাকবে। পান পাতা‚ এলাচ‚ লবঙ্গ একসঙ্গে ফুটিয়ে খেলে সর্দিকাশিতে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যায়।  ১৩. পান হজমে সাহায্য করাসহ গ্যাস‚ অম্বলও কমায়। ১৪. পান শরীরের ব্লাড সার্কুলেশন কমে গেলে তা বৃদ্ধিতে সহায়াতা করে। ১৫. পান খুদামন্দা দুরকরাসহ পেট ফাঁপা কমায়। ১৬. পান পাতা বেটে ক্ষতস্থানে লাগালে সংক্রমনের ভয় থাকেনা, এটি ব্যবহারে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যায়। পানের রসে বেদনানাশকের উপসম হয়। ১৭. নিয়মিত পরিমিত পানের সাথে সুপুরি, চুন, লবঙ্গ খেলে যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়।

পান একটি অর্থকারি ফসলঃ-(Drink is a cash crop)-বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ভারত, সৌদিআরব, আরব-আমিরাত, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি সহ এশিয়া-ইউরোপের আরও অনেক দেশে পান রপ্তানি করা হচ্ছে । বিদেশে রপ্তানীযোগ্য পান উৎপাদন হয় বাংলাদেশের নাটোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা প্রভৃতি জেলায়।  বাংলাদেশে  স্বাধীনতার পর থেকে ইউরোপে পান পাঠানো শুরু হয়। সৌদি আরবে পান পাঠানো হয় ১৯৯১ সাল হতে। বর্তমানে বাংরাদেশে একটি খিলিপান স্থান বিশেষে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্র হয়। বাংলাদেশের অনেক কৃষকেই পানচাষ করে বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা আয করছেন। বর্তমানে পানচাষে অধিক মুনাফা হওয়ায় অনেক বিত্তশালী কৃষক পানচাষের দিকে বিনিয়োগ করছেন, কারন কৃষিক্ষেত্রে বর্তমানে পানচাষে দ্রুত স্বাবলম্বী হওয়া যায।

লেখক/Author

সাংবাদিক অমিতাব বর্মণ।

ভেন্ডাবাড়ী, পীরগঞ্জ-রংপুর।

বাংলাদেশ।
২৩-১১-২০২১ইং।


Saturday, November 20, 2021

কচুরিপানা (Water hyacinth) আজ যা বিলুপ্তির পথে!!


 কচুরিপানা 
কচুরিপানাঃ-(Water hyacinth)-কচুরিপানা একটি জলজ উদ্ভিদ। সাত প্রজাতির কচুরিপানার বংশধর রয়েছে বলে উদ্ভিদ শাস্ত্রে জানা যায়। কচুরিপানা মুক্তভাবে ভাসমান বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। এটি পুরু, চকচকে এবং ডিম্বাকৃতির পাতাবিশিষ্ট , কচুরিপানা পানির উপরিপৃষ্ঠের ওপর ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর কাণ্ড থেকে দীর্ঘ, তন্তুময়, বহুধাবিভক্ত মূল বের হয়, যার রং বেগুনি-কালো। একটি পুষ্পবৃন্ত থেকে ৮-১৫ টি আকর্ষণীয় ৬ পাঁপড়ি বিশিষ্ট ফুলের থোকা তৈরি হয। কালের বিবর্তনে জলাশয়, খাল-বিল, নালা ও পুকুর ভরাট করনের মাধ্যমে বসতবাড়ী  ও কলকারখানা গড়ে উঠার কারনে এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কচুরিপানা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।

কচুরিপানা বর্তমানে খাদ্য তালিকােতও রয়েছেঃ-(Water hyacinth is also on the food list at present)-এটির ডাটা ও ফুল গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তরকারিতে রান্নার তালিকায় রয়েছে বহুকাল ধরে। ডাক্তারি ভাষায় জানা যায়-এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে । আছে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম। এটি একটু বেশি তেলে চিংড়ি দিয়ে রান্না করলে খুবই শুস্বাদু হয়। শুঁটকি ও ইলিশ হলে সোনায় সোহাগা।চাইলে নারকেলের দুধ দিয়েও কচুরির ডাঁটা রাঁধতে পারেন, কচুরির ফুল ডিমের সঙ্গে ভেজে খাওয়াসহ বেসন দিয়েও ভেজে খাওয়া যায়।

কচুরিপানা দেশীয় মাছের নিরাপদ আশ্রয় ও কৃষিতে ব্যবহারঃ-(Water hyacinth is a safe haven for native fish and is used in agriculture)-মাছ চাষে কচুরিপানার ব্যবহার রয়েছে ব্যাপক, গরমে এটি পুকুরের পানি শীতল রাখে। দেশীয় মাছ কচুরিপানার নিচে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। কচুরির দাড়ির মতো শিকড়ের ভাঁজে ভাঁজে মাছ আশ্রয় নেয়। চিংড়ি, কই মাছের খুব প্রিয় আবাস এই কচুরিপানা। চাষিরা অগ্রহায়ণ মাসে কচুরিপানা তুলে চিংড়ি, কই মাছ ধরেন। আলু, হলুদ-আদা, করলা ও পটোলের খেতে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেন চাষিরা, এতে ফসলের ফলন বাড়ে। কচুরিপানা  গ্রামাঞ্চলের কৃষকগন গর্ত করে কচুরিপানার ঢিবি তৈরীকরে পচিয়ে উত্তম জৈবসার তৈরী করে থাকে। কার্তিকমাসে গ্রামাঞ্চলের কৃষকেরা কচুরিপানা গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে। মৎস্য চাষীরা কচুরিপানার শেকড় রাসায়নিক সারের মাধ্যমে পচিয়ে মাছের সুষম খাদ্য তৈরী করছেন।

মশার প্রজনন ক্ষেত্র কচুরিপানাঃ-(Mosquito breeding ground water hyacinth)-জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল ও নালা-নর্দমায় কচুরিপানার ফুল প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করলেও  মশার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রজননক্ষেত্র এই কচুরিপানা। বিশ শতকের প্রথমার্ধে কচুরিপানার জলাশয়ে প্রজননকৃত মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপক ভাবে।

কচুরিপানার জন্ম-মৃত্যুঃ-(Birth and death of water hyacinth)-এটি জলাশয়, নালা, বিল ও পুকুরে সূর্যের তাপ বিকিরণের ফলে শেওলার অণু থেকে জন্মগ্রহন করে। এটি নোনা পানিতে জন্মেনা। এটি শীতের সময়  ধীরে ধীরে মরে যায়।

লেখক/Author

অমিতাব বর্মণ।
সাংবাদিক ও ব্লগার
ভেন্ডাবাড়ী, পীরগঞ্জ, রংপুর।
২০/১১/২০২১ইং।